বায়ু দূষণ কমাতে গাছ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তবে এটা জানা খুবই প্রয়োজন যে, সব ক্ষেত্রে গাছের প্রভাব বা কার্যকারিতা এক নয়।
বিশেষ কিছু গাছ রয়েছে যেগুলি “ফাইটোরিমিডিয়েশন” নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে, যেখানে তারা তাদের পাতার মাধ্যমে দূষণকে শোষণ করে এবং বায়ু থেকে দূষিত কণা পদার্থকে ফিল্টার করে। তারা তাদের সালোকসংশ্লেষের সময় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস গুলিকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। বায়ু দূষণ থেকে মুক্তি পেতে আপনি কি করবেন? সব থেকে সহজ উপায়ের মধ্যে অন্যতম হল “গাছ”। গাছ আমাদের বেঁচে থাকার কারণ। মানুষ যে শুধু ঘরের বাইরে গিয়ে বায়ু দূষণের আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এমনটা নয়, বরং চার দেয়ালের ভেতর থেকোও বায়ু দূষণের প্রভাব শরীরের ভেতরে পড়তে পারে। এর জন্য আপনারা কিছু ইনডোর প্লান্ট (যেসব গাছ ঘরের ভিতরে লাগানো যায়) লাগাতে পারেন, এই সব গাছ গুলো বায়ু দূষণ থেকে বহু মাত্রায় মুক্তি দিতে পারে। বায়ু দূষণ থেকে মুক্তি দেয় এবং অক্সিজেন মুক্ত করে বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করার ক্ষমতার জন্য বেশ কিছু পরিচিত গাছপালা আমাদের আশেপাশেই রয়েছে। তেমনি কয়েকটি ইনডোর প্ল্যান্টের উল্লেখ এখানে করা হলো।
বায়ু দূষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে ইনডোর গাছপালা। Indoor plants to get rid of air pollution.
1.স্পাইডার প্লান্ট (Spider plant): স্পাইডার প্লান্টকে বৈজ্ঞানিক ভাবে ক্লোরোফাইটাম কোমোসাম নামে চেনা যায়। এটি শুধুমাত্র তার সৌন্দর্যের জন্যই পরিচিত নয়, এই উদ্ভিদ বায়ু-বিশুদ্ধ করার ক্ষমতার জন্য খুবই মূল্যবান। এই গাছ সাধারণত ঘরের ভিতরে লাগানো হয়ে থাকে, এটি বেশ কিছু মাত্রায় দূষক কমিয়ে বায়ুর গুণমান উন্নত করতে পারে। এই গাছের পাতার নিচের দিকে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে যাকে বলা হয় “স্টোমাটা”। স্টোমাটা গ্যাস বিনিময়ের অনুমতি দেয়। স্পাইডার প্লান্ট (মাকড়সা গাছ) এর যত্ন নেওয়া খুবই সহজ।
2.পিস লিলি (Peace lilies): পিস লিলি তাদের চেহারা এবং অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণকে নষ্ট করার গুণের জন্য বিখ্যাত। পিস লিলি গাছ সামান্য বিষাক্ত হয় যা খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ত্বকে, মুখে জ্বালাপোড়া, বমি বমি ভাব হতে পারে। এই গাছের মধ্যে ক্যালসিয়াম, অক্সালেট থাকে, যার কারনে ছোট শিশু এবং বাড়ির পোষ্য প্রাণীদের থেকে দূরে রাখা দরকার। তবে বায়ু বিশুদ্ধ করনে এই গাছের বেশ ভালো ভূমিকা রয়েছে। এই গাছ বাড়ি এবং অফিসে লাগানো যেতে পারে, এটি খুব কম আলোতেই দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বায়ু দূষণকে ফিল্টার করতেও এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে —
- অ্যামোনিয়া- পিস লিলি বাতাসে থেকে অ্যামোনিয়া অপসারণ করতে সাহায্য করে।
- বেনজিন- বেনজিন হলো একটি উদ্বায়ী জৈব যৌগ, যা তামাকের ধোঁয়া, রঙ এবং ঘরে থাকা যেকোন কেমিক্যাল কে নষ্ট করে দেয়। এই গাছ অভ্যন্তরীণ স্থানগুলিতে বেনজিনের মাত্রা কমাতে বিশেষ সাহায্য করতে পারে।
- ফর্মালডিহাইড- ফর্মালডিহাইডহলো একটি সাধারণ ইনডোর দূষণকারী, যা বিভিন্ন বাড়ির ভিতরে থাকা সামগ্রী যেমন আসবাবপত্র, কার্পেট সহ আরো অন্যান্য জিনিসের মধ্যে থেকে থাকে। পিসি লিলি বাতাস থাকা সেই ফর্মালডিহাইডঅপসারণ করতে সাহায্য করে।
3.ঘৃতকুমারী (Aloe Vera): অ্যালোভেরা প্রাথমিকভাবে ঔষধি গুণাবলী এবং ত্বকের পরিচর্যার জন্য খুবই পরিচিত, তবে এর কিছু বায়ু বিশুদ্ধ করণ করার গুণাগুণও রয়েছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মতো বায়ু বিশুদ্ধ করণ ক্ষমতার জন্য অ্যালোভেরাকে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন না করলেও কিছু অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণকারী কমাতে এটি কার্যকরী। এই অ্যালোভেরা গাছ বিভিন্ন রঙের মধ্যে থাকা ফর্মালডিহাইড, বেনজিন (তামাকের ধোঁয়া, প্লাস্টিক) ফিল্টার করতে সাহায্য করে।
4.স্নেক প্লান্ট (Snake plant): স্নেক প্লান্ট সানসেভিরিয়া ট্রাইফ্যাসিয়াটা নামেও পরিচিত। এই গাছ তার বায়ু বিশুদ্ধ করার ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত। সাধারণত বাড়ির ভিতরে এই গাছ লাগানো হয়ে থাকে, বায়ু বিশুদ্ধ করণ এবং দূষণকারী ফিল্টার করার জন্য এটি একটি চমৎকার উদ্ভিদ বলে মনে করা হয়।
- ফর্মালডিহাইড- ফর্মালডিহাইড একটি বিষাক্ত যৌগ যা বিভিন্ন গৃহস্থালির পণ্যের মধ্যে যেমন আঠালো জিনিস ও রং এর মধ্যে থাকে। স্নেক প্ল্যান্ট গুলি বাড়ির ভেতরে ফরমালডিহাইড এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- বেনজিন- তামাকের ধোয়া, সিনথেটিক ফাইবার, প্লাস্টিক এবং বিভিন্ন গৃহস্থলীর সামগ্রীর মধ্যে পাওয়া যায়। স্নেক প্ল্যান্ট গুলি এই ধোঁয়ায় মিশে থাকা বাতাসকে ফিল্ডার করতে সাহায্য করে।
5.অ্যারেকা পাম (Areca plum plant): অ্যারেকা পাম বেনজিন, ফর্মালডিহাইড এবং ট্রাইক্লোরোইথিলিনকে পরিশোধন করে। এই গাছ আদ্র মাটি এবং যেসব জায়গায় ভালো হাওয়া-বাতাস চলাচল করে সেরকম জায়গায় রাখা উচিত।
6.মানি প্লান্ট (Money plant): যদিও সমস্ত গাছপালা কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন মুক্ত করে বায়ুর গুনমানকে আরো উন্নত করে তোলে। মানিপ্লান্ট হল এমনই একটি ইনডোর প্লান্ট যা বায়ু বিশুদ্ধকরণ করায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। মানিপ্লান্ট বাতাস থেকে ফর্মালডিহাইড, বেনজিন এবং জাইলিনের মতো দূষণগুলিকে অপসারণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি ঘরে রাখার কারণে মেজাজ উন্নত করে এবং মানসিক চাপ কমায়। এই গাছের যথাযথ পরিচর্যা, জল দেওয়া এবং ধুলো পরিষ্কার করে রাখা খুবই দরকার।
বাম্বু পাম, রাবার ফিগ, এছাড়াও আরো অনেক গাছ রয়েছে যেগুলি আমাদের ঘরের ভিতর থেকে, বায়ু দূষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই গাছগুলি নার্সারি থেকে খুব সহজেই পাওয়া যাবে এবং খুব অল্প টাকাতেই আপনি এটি ঘরে লাগিয়ে বায়ু দূষণ থেকে হওয়া বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
বিশেষ কিছু আউটডোর প্লান্ট রয়েছে যেগুলি বায়ু দূষণ কমাতে বিশেষ সহায়তা করতে পারে।
বায়ু দূষণ কমাতে কিছু বিশেষ বহিরঙ্গন গাছের নাম। some special outdoor plants to reduce air pollution.
বেশ কিছু ভারতীয় গাছ রয়েছে যা দূষক শোষক করে এবং অক্সিজেন মুক্ত করে বায়ু দূষণ কমানোর ক্ষমতা রাখে। এখানে কিছু বিশেষ ধরনের গাছ রয়েছে যা সাধারণত ভারতে পাওয়া যায় এবং বায়ুর গুণমান উন্নত করতে অবদান রাখে—
1. নিম গাছ (Azadirachta indica): নিম গাছ বায়ু বিশুদ্ধকরণ বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। এই গাছ সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) এর মতো দূষক শোষণ করতে পারে।
2.বট গাছ (Ficus religiosa): বট, ডুমুর বা অশ্বত্থ গাছ বায়ুর গুণমান উন্নত করার জন্য খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়, যা কণা পদার্থ এবং অন্যান্য দূষণকারী অপসারণ এ সাহায্য করতে পারে।
3.বাঁশ গাছ (Bambusoideae): বাঁশ গাছ তার দ্রুত বৃদ্ধি এবং দূষণ শোষণ করার ক্ষমতার জন্য বিশেষ পরিচিত। বায়ু দূষণ মোকাবেলায় এটি বড়-বড় শহর অঞ্চলে কার্যকর হতে পারে। এছাড়াও ছোট জাতের কিছু ইনডোর বাঁশ গাছ পাওয়া যায়, যা ঘরের ভিতরে রেখে অনায়াসেই বায়ু দূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
4.বেল গাছ (Aegle marmelos): বেল গাছ শুধুমাত্র তার ঔষধি গুনাগুন কিংবা ধর্মীয় কাজের জন্যই ব্যবহৃত হয় এমনটা নয় বরং দূষণ শোষণ করার ক্ষমতা এবং বায়ুর মান উন্নত করার বিশেষ অবদান রাখে।
5.তুলসী (Ocimum tenuiflorum): তুলসী গাছ পবিত্র তুলসী নামেও পরিচিত। এই তুলসী শুধুমাত্র পুজো, ঐতিহ্যগত ঔষধি গুনাগুন কিংবা স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য ব্যবহৃত হয় এমনটা নয়, বরং দূষণকারী শোষণ করার ক্ষমতার জন্যও এই গাছ খুবই পরিচিত।
6.আমলা (Phyllanthus emblica): আমলা বা ভারতীয় গুজবেরি অক্সিজেন মুক্ত করে এবং দূষক শোষণ করে বায়ু দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারে।
এছাড়াও অশোক, আম, জাম গাছ সহ আরো বিভিন্ন ভারতীয় গাছ রয়েছে যেগুলো দূষণমুক্ত করতে সহায়তা করে। বৈচিত্র্যময় শহরে বন তৈরি করার জন্য বিভিন্ন দেশীয় গাছ লাগানো দরকার। গাছের সঠিক যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ (যেমন, নিয়মিত জল দেওয়া, কীটপতঙ্গ থেকে গাছটি সুরক্ষা করা) গাছের দীর্ঘায়ুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।