বেল বৈজ্ঞানিকভাবে Aegle marmelos নামে পরিচিত। একটি বেল গাছ মাঝারি থেকে বড় আকৃতির হয়ে থাকে। এটি ভারতের স্থানীয় এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়।
বেল গাছ Rutaceae পরিবারের অন্তর্গত। একটি বেল গাছ প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে, এই গাছের ছাল মসৃণ ও ধূসর রঙের, পাতা গুলি ট্রাইফলিয়েট (অর্থাৎ তিনটি পাতা তিন মুখে) এবং সুগন্ধি যুক্ত হয় ও ফুলগুলি সবুজ-সাদা সুগন্ধি যুক্ত হয়ে থাকে।
বেলের বাইরের খোসা শক্ত, এবং ভিতরের অংশে কাঁচা অবস্থায় সাদা ও পাকা অবস্থায় হলুদ থেকে হালকা কমলা রং এর হয় এবং সেই ভিতরের অংশ থাকা মিষ্টি এবং সুগন্ধিযুক্ত স্ট্রাকচারের ভেতর ছোট-ছোট বীজ থাকে, যেগুলি থেকে পুনরায় একটি গাছ উৎপন্ন হতে পারে।
এই গাছের একটি সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। হিন্দু ধর্মে বেল গাছকে পবিত্র ও শুভ বলে মনে করা হয় এবং এটি ভগবান শিবের সাথে যুক্ত। এই গাছের পাতা, ফল ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গাছটিতে অনেক শুভ গুণ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয় এবং এর উপস্থিতি স্বাস্থ্যের অনেক উপকারী বলে মনে করা হয়।
বেল স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী এবং এই বেল দ্বারা বেলের শরবত, জ্যাম, জেলি সহ আরো মিষ্টি খাবার তৈরি করা হয়।
বেল গাছের বিভিন্ন অংশ (পাতা, ফল, শিকড়) ঐতিহ্যগতভাবে ঔষধি গুনাগুনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বেল ফলের মধ্যে জীবাণুরোধি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ডায়রিয়া এবং হজমের মত সমস্যা দূর করতে বেলের শরবত খুব উপকারী।
স্বাস্থ্য উপকারিতায় বেল। Health Benefits of Indian Bael.
পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ বেল: বেলের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও আরও অন্যান্য খনিজ, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতায় বিশেষ অবদান রাখে।
পেটের উপকারিতায়: বেল ফল পেকে যাওয়ার পর তার উপকারিতা বহুগুণ বেড়ে যায়, এটি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয়, ডায়রিয়া এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত সকাল বেলা বেলের শরবত খেলে হজম শক্তি বাড়ে এবং পেটের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নতি: নিয়মিত বেল খাওয়ার ফলে সর্দি, কাশি, হাঁপানির মত বিভিন্ন শ্বাসকষ্টের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। বুকে জমে থাকা কফ বের করে দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসকে আরো সহজ করে তোলে।
ত্বক ও চুলের উপকারিতা: বেলের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলি অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে প্রতিরোধ করে আমাদের ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। বহু ঔষধি উপায়ে বেলের রস চুলের যত্নের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ইমিউন সিস্টেম বৃদ্ধি: বেলের শরবত ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণের হাত থেকে লড়াই করতে সহায়তা করে। বেলের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন ও খনিজ গুলি ইউনিটি পাওয়ার বাড়ায় এবং বেলের শরবত দীর্ঘ সময় ধরে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে পারে, যা শরীরকে ডিহাইড্রেট হওয়া থেকে রক্ষা করে।
হৃদয় স্বাস্থ্য উপকারিতা: কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে বেল কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং কার্ডিওভাসকুলার ফাংশনকে সমর্থন করে, যা হৃদরোগের স্বাস্থ্যের উপর বেশ ভালো একটি প্রভাব ফেলে। এটি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক সহ বিভিন্ন হার্টের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
বেল খাওয়ার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। Consuming Indian bael may cause some side effects.
বেল ফলটি সাধারণত মাঝারি পরিমাণে খাওয়া হলে বেশিরভাগ লোকের জন্য এটি নিরাপদ বলে মনে করা হয়, তবে এই ফল গ্রহণের আগে বিশেষ কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হবে।
হজমের সমস্যা: যদিও বেল হজমের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে অত্যাধিক পরিমাণে বা অপরিপক্ক বেল খাওয়ার ফলে কিছু ব্যক্তির কোষ্ঠকাঠিন্য বা পেট খারাপ হতে পারে।
রক্তে শর্করার মাত্রা প্রভাব: এই ফল রক্তে শর্করার মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের এই ফল কিংবা এর সম্পূরক খাওয়ার আগে সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ এটি রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করতে পারে। তাই আপনার ডায়েটে বেল অন্তর্ভুক্ত করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।
বুকের দুধ খাওয়ানো এবং গর্ভাবস্থায়: বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কিংবা গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন বেলের নিরাপত্তার বিষয়ে একটু সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভবতী বা বুকে দুধ খাওয়ানো মহিলাদের জন্য বেল বা এর সম্পূরক ক্ষতিকারক হতে পারে বলে মনে করা হয়। এটি গ্রহণের আগে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে তবেই খাওয়া ভালো।
পাকা বেল ফলের ঝুঁকি: পাকা বেল ফলের মধ্যে ট্যানিনের উচ্চ ঘনত্ব থাকতে পারে, যা অতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষতিকারক হতে পারে। বেল ফলের এই প্রতিকূল প্রভাব এড়াতে জুস বা জ্যামের মতো প্রক্রিয়াজাত করে এটা খাওয়া ভালো।
কিভাবে একটি ভালো বেল বেছে নিয়ে তা গ্রহণ করবেন, জানেন কি?
- পরিপক্ক হয়েছে কিনা বোঝার উপায়- একটি বেল পেকে গেলে তার ভেতরের অংশ গাঢ় হলুদ বর্ণ ধারণ করে থাকে এবং ভিতরে থাকা দানার গায়ে লেগে থাকা আঠা গুলি অনেক কমে যায়।
- বিল প্রস্তুত করে খাওয়ার নিয়ম- প্রথমে বেলের গায়ে লেগে থাকা ময়লা জল দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। এরপর ফলটিকে দুই ভাগ করে ফাটিয়ে নিয়ে ছুরি কিংবা চামচের সাহায্যে ভিতরের অংশটি বার করে নিয়ে বীজ এবং ভোজ্য পাল্প আলাদা করে নিতে হবে। এরপর বেলের মধ্যে থাকা এই পাল্পটি সরাসরি স্ন্যাকস কিংবা ডেজার্ট হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও লবণ, চাট মসলা, মরিচের গুঁড়ো দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে একটি মজাদার খাবার হিসেবে উপভোগ করতে পারেন।
- বেলের শরবত তৈরি- একটি জুসারের ভিতর পরিমাণ মতো জল, পরিষ্কার করে বেছে রাখা বেলের ভিতরের অংশ, স্বাদ মতো নুন, চিনি বা মধু যোগ করে ভালোভাবে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। তারপর একটা ছাঁকনির সাহায্যে শরবত ভালোভাবে ছেঁকে মন মতো পরিবেশন করুন এবং খান।