Moringaceae পরিবারের অন্তর্গত এই সজনে গাছ বৈজ্ঞানিকভাবে Moringa oleifera নামে পরিচিত। এটি আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু অংশের স্থানীয় হলেও প্রায় সারা দেশেই এই গাছের দেখা মেলে। এটিকে সাধারণত অলৌকিক, ড্রামস্টিক বা বেন তেল গাছ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই গাছের পাতাগুলি পালকের মতো দেখতে হয় এবং সাদা সুগন্ধি ফুল ও লম্বা সরু বীজ যুক্ত ডাটার উৎপন্ন করে। গাছটি ১০ থেকে ১২ মিটার উচ্চতায় লম্বা হতে পারে।
সজনে গাছের বিভিন্ন অংশ ভোজ্য এবং পুষ্টিতে ভরপুর। পাতা, ফুল ও ডাটা (ড্রামস্টিক), এছাড়াও এগুলো বিভিন্ন রন্ধন প্রণালীতে ব্যবহৃত হয়। সজনে গাছের পাতায় প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন ও প্রোটিন রয়েছে। এই পাতাগুলি সুপ, স্টু, সালাদ, ভাজা ও তরকারি সহ আরো অন্যান্য ভাবে খাওয়া যেতে পারে। সজনে ডাটা ড্রামস্টিক নামে পরিচিত, এগুলো সাধারণত তরকারি, সুপ, ফ্রাই সহ আরো অন্যান্য ভাবে খাওয়া হয়। এর বীজ হলো বেন তেলের উৎস, যা পরিষ্কার, গন্ধহীন এবং র্যান্সিডিটি প্রতিরোধ (যখন চর্বি ও তেল গুলো দীর্ঘক্ষণ খোলা থাকে তখন সেগুলো অক্সিডাইস হয়ে যায় এবং বাসি হয়ে যায় যার কারনে তাদের গন্ধ ও স্বাদ পরিবর্তন হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে র্যান্সিডিটি হিসেবে জানা যায়)। বীজগুলি বিভিন্ন ঐতিহ্যগত ঔষধে ব্যবহার হয়ে থাকে। সজনে গাছের বিভিন্ন অংশ ঔষধ ব্যবহারের একটি পুরনো ইতিহাস রয়েছে। এটিতে প্রদাহ বিরোধী, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সজনে গাছের নির্যাস এবং সম্পূরক কখনো কখনো স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বীজ থেকে বার করা তেল বেন তেল নামে পরিচিত, যা বায়োডিজেল, লুব্রিকেন্ট এবং প্রসাধনী উৎপাদন সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়।
সজনে পাতার ব্যবহার। Uses of Moringa leaves.
১. সজনে পাতা সালাদ, স্যান্ডউইচ বা গার্নিশিং এর জন্য টাটকা খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও পাতাগুলি প্রায়শই রান্নায় ব্যবহার হয়, যেমন স্টু, সুপ এবং তরকারিতে সবুজ শাক হিসেবেও এটি খাওয়া হয়ে থাকে।
২. সজনে পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার তৈরি করা হয় যা পুষ্টির পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার যোগ্য। এই পাউডারটি স্মুদি জুস বা খাবারের সাথে যোগ করে স্টু, স্মুদি, জুস বা খাবারের সাথে মিশিয়ে সেই খাবারের পুষ্টি উপাদান বাড়ানো যেতে পারে।
৩. শুকনো সজনে পাতা ভেষজ চা তৈরিতে ব্যবহার হয়, এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়।
৪. গবাদি পশুদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সজনে গাছের পাতা খাওয়ানো হয়ে থাকে। এটি পুষ্টির পরিপূরক হিসেবে বিভিন্ন গবাদি পশুর খাদ্যে ব্যবহার হয়।
সজনে পাতার স্বাস্থ্য উপকারিতা। Health benefits of moringa leaves.
১. সজনে পাতা ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন এবং প্রোটিন সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পুষ্টিতে ভরপুর।
২. এই গাছের পাতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরে ফ্রি রেডিকেল গুলোকে নিরপেক্ষ করতে সাহায্য করে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে মুক্তি দেয়।
৩. কিছু গবেষণায় দেখা গেছে সজনে গাছের পাতায় প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা প্রদাহ জনিত অবস্থায় বিশেষ উপকারী হতে পারে।
৪. এই পাতা শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
৫. সজনে পাতা রক্তে শর্করার মাত্রার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যা ডায়াবেটিস যুক্ত রোগীদের জন্য বেশ উপকারী।
৬. এই পাতায় থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখে।
৭. এই পাতার এন্টি মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য গুলোর কারণে বিভিন্ন সংক্রমণের হাত থেকে লড়াই করতে শরীরকে সাহায্য করে।
সজনে পাতা ব্যবহার সম্পর্কে কিছু সতর্কতা। A few caveats about the use of moringa leaves.
সজনে পাতা স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে থাকলেও, এটি ব্যবহার করা কিংবা খাওয়ার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সতর্কতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
১. সজনে পাতা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার আছে, যার কারণে এটি অতিরিক্ত সেবনের ফলে হজমে অস্বস্তি ঘটাতে পারে। যেমন, পেট খারাপ, ডায়রিয়া, গ্যাস, বদহজম। অল্প পরিমাণে শুরু করা এবং আপনার শরীর অনুযায়ী এটি গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
২. সজনে পাতা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ গ্রহণ করে থাকে তবে তাদের ডায়েটে এই পাতা অন্তর্ভুক্ত করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে না দরকার।
৩. গর্ভবতী কিংবা বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলারা সজনে পাতা নিজের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিন। কারণ এটি বাচ্চা এবং মা, উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
৪. সজনে পাতা খাওয়ার ফলে রক্তের শর্করা মাত্রা দ্রুত কমতে থাকে। যদি কোন ব্যক্তি রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন কিংবা নির্দিষ্ট কোন ডায়েট ফলো করে থাকেন, তবে তাদের এই পাতা সেবার এর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।
৫. সজনে পাতায় এলার্জি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি তার কারণে যাদের অ্যালার্জি রয়েছে তারা এই পাতা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
কিভাবে আপনার চুল এবং ত্বকে সজনে পাতা ব্যবহার করবেন। How to use moringa leaves on your hair and skin.
সজনে পাতার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পুষ্টি, যা চুল ও ত্বকের জন্য খুবই উপকৃত হতে পারে। এখানে কিছু সাধারণ উপায় দেওয়া হলো যা আপনি আপনার চুল এবং ত্বকের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
চুলের জন্য সজনে পাতার ব্যবহার-
মোরিঙ্গা অয়েল হেয়ার মাস্ক: প্রথমে সজনে পাতা থেকে সম্পূর্ণ রস বের করে তার মধ্যে নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন (আপনি আপনার প্রতিদিনের ব্যবহার করা তেল মেশাতে পারেন)। আপনার মাথার ত্বকে এবং চুলের গোড়া পর্যন্ত লাগিয়ে হালকা হাতে ম্যাসাজ করুন। তারপর ৩০ মিনিট রেখে যেকোন নরমাল শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
সজনে পাতার পেস্ট: কয়েকটি তাজা সজনে পাতা ভালোভাবে পেস্ট করে নিয়ে আপনার মাথার ত্বকে এবং পুরো চুলে ভালোভাবে লাগিয়ে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য রেখে দিতে হবে। তারপর যে কোনো নরমাল শ্যাম্পু দিয়ে আপনি ধুয়ে ফেলতে পারেন। এই পেস্টটি আপনার চুলকে পুষ্টি জোগাতে এবং একটি স্বাস্থ্যকর চুল তৈরি করতে সহায়তা করবে।
সজনে পাতার কন্ডিশনার: একটি পাত্রে পরিমান মতো জল নিয়ে সজনে পাতা গুলোকে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিয়ে একটি তরল তৈরি করতে হবে। তারপর সেটাকে ঠান্ডা হতে দিন এবং পাতাগুলোকে ভালোভাবে ছেঁকে নিন। সজনে পাতার এই কন্ডিশনারটি আপনি জলে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন কিংবা স্প্রে হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন l এটি আপনার চুলকে স্মুথ, শাইনি করবে এছাড়াও অতিরিক্ত চুল পড়া রোধ করবে।
ত্বকের জন্য সজনে পাতার ব্যবহার-
সজনে পাতার মাস্ক: টাটকা সজনে পাতা ভালোভাবে পিষে একটি পেস্ট তৈরি করতে হবে। যদি অতিরিক্ত উপকারিতা চান তবে পেস্ট এর মধ্যে এক চামচ মধু বা টক দই মেশাতে পারেন। তারপর আপনার মুখ এবং ঘাড়ে মাস্কটি ভালো করে লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য রেখে দিন, তারপর হালকা গরম জল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
সজনে পাতার স্ক্রাব: সজনে পাতাগুলো শুকিয়ে নিয়ে ভালোভাবে গুঁড়ো করে পাউডার তৈরি করতে হবে। পাউডারের সাথে পরিমাণ মতো জল বা মধু মিশিয়ে একটি স্ক্রাব তৈরি করুন, এরপর হালকা হাতে বৃত্তাকার আকারে আপনার মুখে ও শরীরে ভালোভাবে স্ক্রাবটি লাগিয়ে ম্যাসাজ করুন। ম্যাসাজ করা হয়ে গেলে নরমাল জল দিয়ে সেটি পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলুন।
সজনে পাতার মশ্চারাইজার: একটি কাঁচের বোতলে জোজোবা অয়েল কিংবা বাদাম তেল নিয়ে তার মধ্যে শুকনো কিংবা তাজা সজনে পাতা দিয়ে ভালোভাবে বোতলের মুখ ঢেকে দিন। এটিকে একটি শীতল, অন্ধকার জায়গায় কয়েক সপ্তাহের জন্য রাখতে হবে, মাঝে মাঝে বোতলটি ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। সপ্তাহখানেক পর তেলটি ছেঁকে আলাদা করে নিয়ে, আপনার ত্বকের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে প্রতিদিন ব্যবহার করতে পারেন।
আপনার ত্বকে এবং চুলে সজনে পাতা ব্যবহার করার আগে আপনার এর প্রতি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে কিনা, তা অবশ্যই একটি প্যাচ টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করে নিন।