ত্রিফলা (Triphala) হল একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার উপাদান যা তিনটি গুণসম্পন্ন ফল থেকে তৈরি হয়ে থাকে। এটি বহু শতাব্দী ধরে ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ত্রিফলা নামটি সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে । “ত্রি” যায় অর্থ তিনটি ফল এবং “ফলা” যার অর্থ ফল। ত্রিফলা আমলকি, হরিতকি, বহেরা বা বিভিতকি ফলের শুকনো গুঁড়া দিয়ে তৈরি। এই ফল গুলোর প্রত্যেকটিতেই স্বাস্থ্য, ত্বক ও চুল রক্ষায় অসামান্য ভূমিকা আছে। ত্রিফলা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্যও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্রিফলা হজম শক্তি উন্নয়নের সাথে সাথে ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই ভালো এবং আপনি এটি সেবন করে ওজন কমাতে পারেন।
ত্রিফলা সক্রিয় যৌগ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ঔষধি গুনাগুনের জন্য উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে।
ত্রিফলার ঔষধি গুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা। Triphala health and medical benefits.
ত্রিফলা একটি আয়ুর্বেদিক ভেষজ প্রতিকার যা তিনটি ফল নিয়ে গঠিত: আমলা (Emblica officinalis), হরিতকি (Terminalia chebula), এবং Bibhitaki (Terminalia bellirica)।
আমলকি (Emblica officinalis) – আমলকি Vitamin C, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফাইবার ও পলিফেনল এ সমৃদ্ধ।
সংস্কৃততে আমলকি অমৃত ফল নামে পরিচিত। এটি ভারতে বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মানুষ এটি ফল, রস, আচার এবং গুঁড়ো আকারে গ্রহণ করে। ভিটামিন C -তে সমৃদ্ধ এই আমলকি রোগ প্রতিরোধ শক্তি ও মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে, সর্দি-কাশি, ভাইরাল বা ব্যাক্টিরিয়াল ইনফেকশনের হাত থেকে রক্ষা করে, ক্যান্সার সেলের সংখ্যা কমাতে পারে। আয়ুর্বেদ অনুযায়ী আমলকির রস শরীরের সমস্ত প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য রক্ষা করে এবং বাতের ব্যথা, কফ এবং পিত্ত থেকে মুক্তি দেয়।
বহেরা বা বিভিতকি (Terminalia Bellirica) – ইলাজিক অ্যাসিড, গ্যালিক অ্যাসিড, চেবুলিক অ্যাসিড এ ভরপুর।
এটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। অকালে টাক পড়লে বহেরা বীজ অল্প জলে মিহি করে বেটে টাকে লাগালে টাক সেরে যায়, ফোলা কমানোর জন্য বহেরার বীজ বাদ দিয়ে ছাল বেটে একটু গরম করে ফোলায় প্রলেপ দিলে ফোলা কমে যায় এবং শাঁসের গুঁড়া ডালিম পাতার রসের সাথে মিশিয়ে খেলে কৃমি দূর হয়। বহেরাতে থাকা গ্যালিক এবং ট্যানিক অ্যাসিড, বমির সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে।
হরিতকি (Terminalia Chebula) – হরিতকি ট্যানিনস, পলিফেনল, গ্যালিক অ্যাসিড, চেবুলিক অ্যাসিড এ সমৃদ্ধ।
এটি একটি বাদামের মতো ফল। পাকার পর হলুদ বর্ণ ধারণ করলে তা ভেঙে যায়। এটিকে সাধারণত ‘হারাদ’ও বলা হয়। হরিতকীর মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন C, আয়রন, সেলেনিয়াম, ম্যাংগানিজ, কপারের মতো খনিজ। এর ফলে আমাদের চুলের সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হরীতকীর অবদান অনেক। হরিতকী থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা আমাদের গ্যাসের সমস্যা থেকে দারুণ ভাবে মুক্তি দেয়। মলের অনিয়ম বা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ও হরিতকী ভীষণ ভাবে কার্যকরী।
ত্রিফলা খাওয়ার উপকারিতা।
1.পরিপাক স্বাস্থ্য: ত্রিফলা স্বাস্থ্যকর হজমের প্রচারের জন্য পরিচিত। এটি অন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করতে, অন্ত্রের গতিবিধি সহজ করতে এবং নিয়মিততা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
2. ডিটক্সিফিকেশন: ত্রিফলা প্রায়ই প্রাকৃতিক ডিটক্সিফায়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি শরীর থেকে বর্জ্য, বিষাক্ত পদার্থ এবং জমে থাকা অপচয় নির্মূল করতে সহায়তা করে। এই ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া পরিষ্কার ত্বক, উন্নত শক্তির মাত্রা এবং সুস্থতার অনুভূতিতে অবদান রাখতে পারে।
3. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য: ত্রিফলার তিনটি ফল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, বিশেষ করে আমলকি থেকে পাওয়া ভিটামিন C। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষগুলিকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে এবং সামগ্রিক সুস্থতায় অবদান রাখে।
4. ইমিউন সিস্টেম সাপোর্ট: আমলকিতে থাকা উচ্চ ভিটামিন C ইমিউন সিস্টেমকে সমর্থন করতে সাহায্য করে। একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
5. ওজন ম্যানেজমেন্ট: ত্রিফলা দক্ষ হজম এবং বিপাকের উন্নীত করে ওজন ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে। এটি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে এবং ওজন কমাতে সহায়তা করতে পারে।
6. চোখের স্বাস্থ্য: আমলা, উপাদানগুলির মধ্যে একটি, ভিটামিন C এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ যা চোখের স্বাস্থ্যকে সমর্থন করতে এবং চোখের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
7. ওরাল হেলথ: ত্রিফলা মুখের দুর্গন্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সামগ্রিক মুখের স্বাস্থ্য কে সমর্থন করে মৌখিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়।
8. স্ট্রেস রিলিফ: ত্রিফলা স্নায়ুতন্ত্রের উপর একটি শান্ত প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়, চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।
9. হৃদয়ের স্বাস্থ্য: ত্রিফলার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রভাবগুলি অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ কমিয়ে কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের অবদান রাখতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ।
10. প্রদাহ-বিরোধী প্রভাব: ত্রিফলার কিছু যৌগগুলিতে প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রদাহ কমাতে এবং বিভিন্ন প্রদাহ জনক অবস্থা থেকে মুক্তি প্রদান করতে সহায়তা করতে পারে।
11. ব্লাড সুগার রেগুলেশন: কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে ত্রিফলা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে, যা ডায়াবেটিস বা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য উপকারী হতে পারে।
12. ত্বকের স্বাস্থ্য: ত্রিফলার ডিটক্সিফাইং এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য পরিষ্কার ত্বক এবং একটি স্বাস্থ্যকর চেহারা অবদান রাখতে পারে.
এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে যদিও ত্রিফলা আয়ুর্বেদিক ওষুধে ব্যবহারের একটি দীর্ঘ ইতিহাস এবং অনেক সম্ভাব্য সুবিধা রয়েছে, এর কার্যকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এখনও চলছে, এবং পৃথক ফলাফল পরিবর্তিত হতে পারে। আপনি যদি ত্রিফলাকে এর সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য ব্যবহার করার কথা ভাবছেন, তাহলে একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সাথে পরামর্শ করার পরামর্শ দেওয়া হয়, বিশেষ করে যদি আপনার কোনো পূর্ব-বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে বা ওষুধ সেবন করেন।
ত্রিফলা খাওয়ার নিয়ম। Rules for taking Triphala as food.
ত্রিফলা পাউডার, ক্যাপসুল, ট্যাবলেট এবং তরল নির্যাস সহ বিভিন্ন আকারে ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনার পছন্দ করা নির্দিষ্ট ফর্মের উপর ভিত্তি করে ডোজ এবং ব্যবহারের নির্দেশাবলী পরিবর্তিত হতে পারে।
১. ত্রিফলা গ্রহণের আগে সম্ভাব্য কিছু নির্দেশাবলী মেনে তা গ্রহণ করলে আপনি এর সব থেকে ভালো উপকারিতা গুলো পেতে পারেন। আয়ুর্বেদিক অনুসারে ত্রিফলা খাওয়ার জন্য ঘি এবং মধুর ব্যবহার সব থেকে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়।
২. আয়ুর্বেদিক ত্রিফলা সাধারণত সকালবেলা খালি পেটে কিংবা সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। এটি অন্যান্য খাবার বা ওষুধের হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভেষজ প্রস্তুতিকে কাজ করতে দেয়। খালি পেটে ত্রিফলা খেলে হজম শক্তি এবং শারীরিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। রাত্রে খাওয়ার কম করে ৩০মিনিট থেকে এক ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপরে এটি গ্রহণ করা উচিত।
৩. ত্রিফলা গ্রহণ করার আগে অবশ্যই খুবই কম পরিমাণ ডোজ থেকে আসতে আসতে ডোজ বাড়ানো উচিত। কারণ এটি কিছু মানুষের শরীরে ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
৪. ক্যাপসুল কিংবা ট্যাবলেট ব্যবহার করে থাকলে তা আপনি আপনার সুবিধামতো গ্রহণ করতে পারেন। তবে যদি আপনি ত্রিফলা পাউডার ব্যবহার করেন তাহলে এক গ্লাস উষ্ণ গরম জলে 1/2 থেকে 1 চা চামচ (2-5 গ্রাম) ত্রিফলা পাউডার এবং স্বাদের জন্য এক চামচ মধু মিশিয়ে তা গ্রহণ করতে পারেন।
ত্রিফলায় উপস্থিত আমলকি, হরিতকি ও বহেরা, প্রত্যেকের নিজস্ব গুণাবলী ও ঔষধি গুন রয়েছে। আপনি যদি নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যের চাহিদার উপর নির্ভর করে এগুলির সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করতে চান তাহলে অবশ্যই একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিন।
ত্রিফলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। Triphala side effects.
আমলকি, হরিতকী ও বহেরা এই তিনটি ফল সাধারণত আয়ুর্বেদিক ঔষধে একত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা ত্রিফলা নামে পরিচিত। এই ত্রিফলা বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা জন্য বহু বছর ধরে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। তবে কিছু পরিস্থিতিতে এই ফলগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া হয়ে থাকে।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এর সমস্যা: ত্রিফলা উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ। এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার ফলে গ্যাসের সমস্যা, ফোলা ভাব, ডায়রিয়ার মতো আরও বিভিন্ন পাচনতন্ত্র গঠিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
লো ব্লাড সুগার (হাইপোগ্লাইসেমিয়া): ত্রিফলার মধ্যে উপস্থিত আমলকি সহ আরো দুটি উপাদান হরিতকি ও বহেড়া রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে পারে। যেসব ব্যক্তিদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তাদের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এগুলি গ্রহণ করা উচিত।
কিডনিতে পাথর: ত্রিফলার অন্যতম উপাদান হরিতকিতে প্রচুর পরিমাণে অক্সালেট রয়েছে যা সাধারণত কিডনির সমস্যা যুক্ত ব্যক্তিদের শরীরে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় সমস্যা: যদিও এই ফলগুলোকে নিরাপদ বলেই মনে করা হয়ে থাকে, তবুও গর্ভবতী মহিলা কিংবা বুকের দুধ খাওয়ানোকালীন মহিলাদের সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যই উচিত। এই ফলগুলি নিজেদের খাদ্যে অন্তর্ভুক্ত করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।
এলার্জি প্রতিক্রিয়া: এই তিনটি ফল একত্রে গ্রহণ করায় কিছু মানুষের এলার্জির মতন প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন গাল ফুলে যাওয়া, লাল ভাব, শ্বাসকষ্টের মতন সমস্যা। যদি এমন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই এটি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন কিংবা একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিন।