রসুন পেঁয়াজ পরিবারের (Alliaceae) একটি বহুল ব্যবহৃত ভেষজ এবং সবজি যার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালিয়াম স্যাটিভাম। এই রসুন তার স্বতন্ত্র-তীব্র গন্ধ, ঔষধি গুণ ও বিভিন্ন রন্ধনসম্পর্কীয় ব্যবহারের জন্য পরিচিত। রসুন একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। রসুন গাছের সবচেয়ে ব্যবহৃত অংশ হলো বাল্ব, যা একটি সাদা কাগজের মতো চামড়ায় আবদ্ধ থাকা একাধিক লবঙ্গ। প্রতিটি লবঙ্গ রোপন করলে একটি নতুন রসুন গাছের উৎপন্ন হয়। রসুন গাছের গোড়া থেকে বের হয় এবং গাছ গুলো লম্বা, সরু ও সবুজ পাতাযুক্ত হয়ে থাকে। এটি একটি তীক্ষ্ণ-ঝাঁঝালো সুগন্ধ ও স্বাদ রয়েছে যা কাঁচা এবং শুকনো দুই অবস্থাতেই খাওয়া যেতে পারে। যেমন রসুনের গুঁড়া, পেস্ট বা ভাতের সাথে কাঁচা খাওয়া। ইতালীয়, ভূমধ্যসাগরীয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত সহ বিভিন্ন দেশে রান্নায় রসুনের ব্যবহার হয়ে থাকে। রসুন বিভিন্ন ভিটামিন (ভিটামিন C এবং B6) খনিজ (সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ) ও খাদ্যতালিকাগত ফাইবার সরবরাহ করে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তবে এটি রান্নায় ব্যবহৃত ও পুষ্টি ছাড়াও বিভিন্ন ঔষধি গুনাগুনেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি এবং কার্ডিওভাসকুলার বৈশিষ্ট্য।
রসুনের পুষ্টি, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান।
100 গ্রাম কাঁচা রসুনের পুষ্টি চার্ট:
- ক্যালোরি: 149
- কার্বোহাইড্রেট: 33.06 গ্রাম
- খাদ্যতালিকাগত ফাইবার: 2.1 গ্রাম
- প্রোটিন: 6.36 গ্রাম
- মোট ফ্যাট: 0.50 গ্রাম
- Vitamin C: 31.2 মিগ্রা (দৈনিক মূল্যের 52% বা DV)
- Vitamin B6: 1.235 মিগ্রা (DV-এর 62%)
- ক্যালসিয়াম: 181 মিগ্রা (DV-এর 18%)
- ম্যাঙ্গানিজ: 1.672 মিগ্রা (DV- এর 83%)
- ফসফরাস: 153 মিগ্রা (DV- এর 15%)
- পটাশিয়াম: 401 মিগ্রা (DV- এর 11%)
ভিটামিন ও খনিজের উপকারিতা: রসুনে থাকা ভিটামিন C অ্যাসকরবিক অ্যাসিড নামে পরিচিত। এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা কোলাজেন সংস্লেশন, ক্ষতি নিরাময় এবং ইউনিয়ন ফাংশনের সমর্থন করে। B6 অ্যামিনো অ্যাসিডের বিপাক এবং নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদন সহ শরীরের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য, পেশীর কার্যকারিতা, স্নায়ুর সংকেত এবং শক্তি বিপাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পটাশিয়াম সঠিক তরল ভারসাম্য বজায় রাখে। ম্যাঙ্গানিজ একটি ট্রেস খনিজ, এটি হাড় গঠন, রক্ত জমাট বাঁধতে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষায় বিশেষ অবদান রাখে।
রসুনের ঔষধি গুনাগুন ও উপকারিতা। Medicinal properties and benefits of garlic.
কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য: রসুন হার্টের স্বাস্থ্য এর উপর বেশ ভালো প্রভাব ফেলতে পারে। এটি রক্তচাপ কমাতে, LDL (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে এবং রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। অ্যালিসিন ও সালফার যৌগ কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রভাব: এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর মধ্যে ফ্ল্যাভোনয়েড এবং সালফার যুক্ত যৌগ রয়েছে, যা শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি রেডিকেল গুলির হাত থেকে নিরপেক্ষ করতে সাহায্য করে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং অক্সিডেটিভ ক্ষতির সাথে যুক্ত দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়।
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল: এতে অ্যালিসিন রয়েছে, যা প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি যৌগ। এটি সাধারণত সর্দি, কাশি, সিজনাল ফ্লু সহ বিভিন্ন সংক্রমন ও জীবাণুর আক্রমণ কারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
আন্টি-ইনফ্লেমেটরি: দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, বাত এবং ক্যান্সার সহ অসংখ্য রোগের সাথে যুক্ত এই রসুন। এর আন্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ কমাতে এবং রোগগুলো নির্মূল করতে সহায়তা করে।
যৌন সমস্যা নির্মূল: রসুন ঐতিহ্য কত ভাবে যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং যৌন সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
১. বর্ধিত লিবিডো: রসুন রক্ত সঞ্চালন উন্নত করার সম্ভাবনার কারনে কাম শক্তি বাড়াতে পারে। ভালো রক্ত প্রবাহ যৌন ফাংশন উন্নত করে।
২. বর্ধিত শুক্রাণুর গুণমান: রসুন শুক্রাণুর মানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যার মধ্যে শুক্রাণুর গতিশীলতা রয়েছে। তবে এটি প্রভাবের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
৩. হরমোনের ভারসাম্য: এতে থাকা কিছু যৌগ শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কখনো কখনো যৌন সমস্যায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে, তবে হরমোন নিয়ন্ত্রণে রসুনের নির্দিষ্টতা ভালোভাবে বোঝা যায় না।
রন্ধনসম্পর্কীয় প্রস্তুতিতে রসুনের ব্যবহার।
রসুন বিভিন্ন ভাবে রান্না করা হয় এবং অন্যান্য খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। রসুন কি যত সুখ ভাবে কাটা যায় তার স্বাদ ততটাই শক্তিশালী হয়। এটি বিভিন্ন মাংস, মাছ ডিম, এছাড়াও আর অন্যান্য শাকসবজিতেও রসুনের ব্যবহার হয়ে থাকে। বেশ কিছু বিদেশি রেসিপি রয়েছে যা শুধুমাত্র রসুনের দিয়ে তৈরি হয়। এর সবথেকে সহজ রেসিপি হল গার্লিক চিকেন, চিকেন স্যুপ, গার্লিক রোস্ট চিকেন, গার্লিক ফ্রাইড রাইস, গার্লিক লেমন চিকেন পাস্তা, গার্লিক বাটার চিংড়ি সহ বিভিন্ন রেসিপি আছে, এগুলি ভীষণ সুস্বাদু এবং মজাদার, খুব কম সময়ের মধ্যে বাড়ীতে রান্না করা যেতে পারে। এছাড়াও রসুন দিয়ে তৈরি ক্রিমি মেয়োনিজ প্রায়ই স্যান্ডউইচ, বার্গার আর অন্যান্য খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য আমরা ব্যবহার করে থাকি।
রসুন খাওয়ার সময় মেনে চলুন কিছু সতর্কতা। Follow some precautions while consuming garlic.
দুর্গন্ধ (হ্যালিটোসিস): রসুন খাওয়ার সব থেকে সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলির মধ্যে একটি হল দুর্গন্ধ। এতে থাকা সালফার যৌগ মুখে ভেঙে গেলে, মুখের ভেতর থেকে একটা তীব্র দুর্গন্ধ বের করতে পারে, যা বেশিরভাগ মানুষের কাছে খুবই অপ্রিয়। সেক্ষেত্রে এটা খাওয়ার পর যথা সময়ে দাঁত ব্রাশ করে নেওয়া কিংবা মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও এই দুর্গন্ধ আমাদের শ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছাড়াও ঘাম এবং ত্বকের মধ্য থেকে নির্গত হতে পারে।
ত্বকের সমস্যা: কিছু ক্ষেত্রে কাঁচা রসুন খাওয়ার পর বেশ কিছু মানুষের ত্বকে জ্বালা বা হালকা ফুসকুড়ি হতে পারে, সেক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ এটি গ্রহণ করে দেখা উচিত।
গ্যাস-অম্বলের সমস্যা: রসুন খেলে বেশ কিছু মানুষের গ্যাস-অম্বলের মতো সমস্যা হতে পারে, যদি সেই ব্যক্তির আগে থেকেই গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা থেকে থাকে।
হজমে সমস্যা: রসুন খেলে পেট ফোলা, গ্যাস, ডায়রিয়া ও হজম সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে এটি বেশি পরিমাণে খেলে কিংবা সংবেদনশীল পাচন তন্ত্রের ব্যক্তিরা সেবন করলে।
রক্তপাতের ঝুঁকি: এতে রক্ত পাতলা করার মতো বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে, অন্টিকোয়াগুল্যান্ট ওষুধের পাশাপাশি রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায় এবং রক্ত জমাট বাঁধতে হস্তক্ষেপ করে।