আতা ও আতা গাছ বৈজ্ঞানিক ভাবে অ্যানোনা রেটিকুলাটা (Annona reticulata) নামে পরিচিত, এটি একটি গ্রীষ্মমন্ডল এবং উপক্রান্তীয় ফলের গাছ, যা কাস্টার্ড আপেল, মিষ্টি আপেল সহ আরও বিভিন্ন নামে পরিচিত। কাস্টার্ড আপেল আমেরিকার স্থানীয় ফল, তবে এখন সারাবিশ্বেই এটি ব্যাপকভাবে উৎপাদন হয়। এই ফল সাধারণত গোলাকার বা হৃদপিন্ডের আকৃতির হয়, কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় হলুদ, লাল ও বাদামী সহ জাতের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রঙের হতে পারে, এর ভিতরে ছোট কালো অসংখ্য বীজ থাকে এবং এই বীজের চারপাশে অবশিষ্ট রসালো এবং মিষ্টি আঁশযুক্ত অংশ খাওয়া হয়। এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ধরা শুরু করে এবং আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পেকে খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়।
একটি ছোট থেকে মাঝারি আতা গাছের উচ্চতা ১৫ থেকে ৩০ ফুট (৪-৯ মিটার) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই গাছের পাতা চকচকে সবুজ, গোলাকার থেকে হালকা লম্বা, সাধারণত ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি (১০-২০ সেন্টিমিটার) লম্বা হয়। আতা গাছে সুগন্ধি, সবুজ, হলুদ থেকে হালকা ফ্যাকাশে হলুদ রঙের ফুল হয়।
ঐতিহ্যবাহী ঔষধি গুনাগুণে আতা গাছের পাতা, বীজ এবং শিকড় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে আতা ফলের বীজ খাওয়ার জন্য একদমই উপযুক্ত নয় কারণ এটি শক্ত এবং প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত হয়ে থাকে। এটি পাকা অবস্থায় ফল হিসেবে খাওয়া হয়, এছাড়াও এটি বিভিন্ন রন্ধনসম্পর্কীয় প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন স্মুদি, ডেজার্ট, মালাই, কাস্টার্ড ক্ষীর, সন্দেশ, আইসক্রিম। কাস্টার্ড আপেল ভিটামিন (C, B6) ও খনিজ পদার্থ (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম) এর মতো বিভিন্ন পুষ্টির একটি ভালো উৎস।
আতার পুষ্টি (Nutrition’s), ভিটামিন ও খনিজ উপাদান।
100 গ্রাম আতার পুষ্টি উপাদান:
- ক্যালরি: 94
- কার্বোহাইড্রেট: 23.6 g
- ডায়েটারি ফাইবার: 4.4 g
- প্রোটিন: 2.1g
- Vitamin C: 19.2 মিলিগ্রাম
- Vitamin B6: 0.12 মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম: 247 মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম: 9 মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: 30 মিলিগ্রাম
- জলের পরিমাণ: 71.5 গ্রাম
ভিটামিন ও খনিজ: আতা ভিটামিন C এর একটি ভালো উৎস যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে এবং উদ্ভিদ ভিত্তিক খাবার থেকে আয়রন শোষণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন B6 লোহিত রক্তকণিকা গঠন, শারীরিক ক্রিয়া-কলাপে সহায়তা এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। পটাশিয়াম খুব ভালো একটি খনিজ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক হৃৎপিণ্ড ও পেশির কার্যকারিতা বজায় এবং স্ট্রোক ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে। ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য, পেশির স্বাস্থ্য এবং রক্ত জমাট বাঁধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাগনেসিয়াম শরীরের ৩০০ টিরও বেশি এনজাইমেটিক প্রতিক্রিয়ার সাথে জড়িত, যার মধ্যে পেশী, স্নায়ু এবং রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ও হাড়ের স্বাস্থ্য রয়েছে। এছাড়াও ফসফরাস সহ আরও অন্যান্য খনিজ রয়েছে, যেগুলি আমাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে থাকে।
আতা গাছের ফল, পাতা, বীজ ও শিকড়ের ঔষধি গুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা। Medicinal Properties and Complete Benefits of Custard apple, Leaves, Seeds and Roots.
ফল
ক্যান্সার প্রতিরোধ: বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কাস্টার্ড আপেল অর্থাৎ আতা ফলে অ্যাসিটোজেনিন নামক একটি প্রাকৃতিক যৌগ রয়েছে, যা স্তন ক্যান্সার সহ আরো অন্যান্য ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
হাড়ের স্বাস্থ্য: আতায় উপস্থিত ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম এর মতো খনিজ শক্তিশালী হাড় ও দাঁতকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পরিমাণে এই খনিজ গ্রহণ করলে হাড়ের ঘনত্ব এবং হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: এই ফলে উপস্থিত খাদ্যতালিকাগত ফাইবার শরীরকে অনেকক্ষণ ধরে পূর্ণতার অনুভূতি যোগায়, যা সামগ্রিক ক্যালরি গ্রহণ কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে বিশেষ সাহায্য করতে পারে।
স্নায়ুর কার্যকারিতা: এতে উপস্থিত ভিটামিন B6 পাইরোডক্সিন স্নায়ুর কার্যকারিতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিটামিন এবং এটি স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
হাইড্রেশন: আতা ফলে উচ্চ পরিমাণে জলের উপাদান রয়েছে, যা আমাদের শরীরকে হাইড্রেট এবং রিফ্রেসিং রাখতে সাহায্য করে। গরম আবহাওয়ায় এই ফল আমাদের শরীরকে দীর্ঘসময়ের জন্য ঠান্ডা রাখতে পারে।
স্ট্রেস থেকে মুক্তি: এই ফলে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়ামের উপাদান স্ট্রেস কমাতে এবং শরীরকে শিথিল করতে সাহায্য করে। কারণ ম্যাগনেসিয়াম স্নায়ুতন্ত্রের উপর একটি শান্ত এবং হালকা প্রভাব ফেলতে পারে।
পাতা
আতা গাছের পাতায় আন্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ত্বকের সংক্রমণ, ক্ষত এবং অন্যান্য জীবাণু সম্পর্কিত সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়, এন্টি-ডায়াবেটিক বৈশিষ্ট্য রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়।
শিকড়
আতা গাছের শিকড় আমাশয় এবং ডায়রিয়ার জন্য খুবই উপযোগী। এর মূলের নির্যাস গুলিতে এন্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইনাল সমস্যার জন্য দায়ী প্যাথোজেন গুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এছাড়াও জ্বর, সর্দি কাশির মতো ভাইরাস থেকেও এর পাতা বিশেষ উপকারিতা দিতে পারে।
বীজ
আতার বীজে অ্যাসিটোজেনিন নামক একটি প্রাকৃতিক যৌগ রয়েছে, যা তাদের কীটনাশক বৈশিষ্ট্যের জন্য ধরা হয়, এই যৌগগুলি কৃষির কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করতে পারে। এবং এই বীজের অ্যাসিটোজেনিনের উপাদান ক্যান্সারের কোষকে বৃদ্ধি পেতে বাধা দেয় ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে।
আতা খাওয়ার নিয়ম এবং ব্যবহার
আতা বেশিরভাগ সময়ে তাজা খাওয়া হয়ে থাকে, কারণ এটির মধ্যে একটি ক্রিমি, মিষ্টি মাংস থাকে যা খাওয়ার সময় খুবই সুন্দর অনুভূতি যোগায়। এটি আস্ত রান্না করার ফলে এর গঠন এবং গন্ধ পরিবর্তন হতে পারে, সেক্ষেত্রে এটি বেশ কিছু মানুষের কাছে অপ্রিয় লাগতে পারে। তবে এই ফল পাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়, যেমন ডেজার্ট, স্মুদি, শেক, জ্যাম, সস, চাটনি, শরবত, আইসক্রিম, পায়েস, সন্দেশ, কেক, ক্ষীর।
আতা ফল এর কিছু অপকারিতা। Some disadvantages of Custard apple.
ক্যালরি উপাদান: কাস্টার্ড আপেলের ক্যালরি তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফলের চাইতে কিছুটা কম, তবে এই সামগ্রিক ক্যালোরি গ্রহণের সাথে ভারসাম্য না থাকলে অতিরিক্ত সেবন করলে ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এলার্জি ও ত্বকের সংবেদনশীলতা: এই ফলে এলার্জি বা ত্বকের সংবেদনশীলতা হতে পারে। সেক্ষেত্রে চুলকানি, ফোলা ভাব, গা-হাত লাল হয়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে অসুবিধা মতো কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এমনটা হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।
বিষাক্ত বীজ: আতার বীজ এমন কিছু যৌগ রয়েছে যা প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত হতে পারে। ভুলবশত একটা কিংবা দুটো বীজ খাওয়ার ফলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তেমন না হলেও, ইচ্ছাকৃত অনেক বেশি বীজ খেয়ে ফেলার পরে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই কাছাকাছি কোন হাসপাতালে গিয়ে চেকআপ করি না দরকার।
অতিরিক্ত পেকে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া: আতা সম্পূর্ণ পেকেছে কিনা সেটা বিচার করার একটু কঠিন, তবে এটি পাকার সাথে সাথে একটি হালকা হলুদ বর্ণের রং ধারণ করে। অত্যধিক পেকে যাওয়ার ফলে এটির একটি অপ্রীতিকর গন্ধ এবং বাজে স্বাদ তৈরি হয়, যা খাওয়ার জন্য একদমই উপযুক্ত নয়।